অনুবাদ : চিরদীপ নাহা
(আমি এই গল্পটি/প্রবন্ধটি আমার হোয়াটস্যাপ ফ্যামিলি গ্রুপকে উৎসর্গ করছি যারা আমাকে এটি এবং এছাড়াও অনেক কিছু লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। হয়তো ভবিষ্যতে আমি আরো লিখবো)
হজমসংক্রান্ত সমস্যা বাঙালিদের জীবনে একটি নিত্যদিনকার ঘটনা। এই জিনিসটি ছাড়া তাদের জীবন কল্পনা করা যায় না। তাদের নিত্যদিনকার জীবনে অম্বল, গা গোলানো , পেট নরম হওয়া, গ্যাস্ট্রিক ইত্যাদি জিনিসগুলো থাকে। বাঙালিদের মতে গ্যাস্ট্রিক পাকস্থলীর ঠিক পাশে শরীরের একটি অঙ্গ যেটা অন্ত্রের সাথে যুক্ত এবং পিত্তথলি, লিভার এবং খাদ্যনালীর সাথে এর কোনো না কোনো যোগাযোগ আছে যা সব ধরণের খাদ্য জনিত জটিল রোগের অন্যতম কারণ ।
বাঙালিরা আমোদের সাথে খায় দায়, চিন্তা করে , স্বপ্ন দেখে এবং কথা বলে ।
আমি এমন এক পরিবার থেকে আসি যেই পরিবারের খাবার, বিভিন্ন ধরণের রেসিপি, রান্না করা এবং রান্নার বইয়ের সাথে তাদের সম্পর্ক জগৎবিখ্যাত। নিত্যদিনকার সাধারণ বাঙালি খাবারকে (একটু টুইক করে )অসাধারণ বানানো ঠাকুরবড়ির রান্নাঘরের একটি ঐতিহ্য। ধরো ঠাকুর বাড়ির দুধ কাতলা যেটি প্রচন্ড গরমের সময় একটি যথোপযোগী খাবার। এটা বানাতে কাতলা মাছের সাথে যোগ করা হয় কনডেন্সড মিল্ক, ফুল ক্রিম মিল্ক এবং সরিষার তেল। কুঁচানো আদা এবং পেঁয়াজের রস মনে হাতে পারে তেমন কিছু নয় কিন্তু যদি যথাযথ ভাবে দুধ কাতলার সাথে ব্যবহার করা হয় তাহলে যে কোনো নাক সিঁটকানো বাঙালিও উৎসাহিত ভোজনকারীতে পরিণত হবে।
আমি বড়ো হয়ে উঠেছি খাবারকে অপছন্দ করে। খাবারের সময়গুলো আমার এবং আমার পার্শ্ববর্তী মানুষদের জন্য প্রচন্ড যন্ত্রণাদায়ক ছিল। আমি আমার উচ্চতা অনুযায়ী অনেকটাই শীর্ণ ছিলাম এবং এখনো আছি। আমি লম্বায় প্রায় ৬ ফিট ১ এবং আমার ওজন ১৩৫ পাউন্ড। স্বাভাবিকভাবেই আমি দেখতে আর দশটা বাঙালি মহিলাদের থেকে কিছুটা আলাদা। বেড়ে উঠার সময় আমি এতোটাই শীর্ণ ছিলাম যে প্রায়ই আমাকে অনেক অপমান জনক কথাবার্তা শুনতে হতো, তার মধ্যে কাঠির মাথায় আলুর দম কথাটি আমার অন্যতম প্রিয় ছিল। আমার মা বাবাকে প্রায়ই উপদেশ শুনতে হতো পরিবার, বন্ধু এবং কখনো কখনো অপিরিচিত ব্যক্তিদের থেকে যে কিভাবে আমাকে মানে কাঠির মাথায় আলুর দমকে মোটা করা যায়। মা বাবাকে প্রায়ই বলা হতো ওকে আলু সেদ্ধ এবং ভাত খাওয়াও । হয়তো এইজন্যই এখনো আমি কাঁচা লঙ্কা ,নুন এবং সরিষার তেল দিয়ে মাখিয়ে সেদ্ধ ভাত খেতে এতটা স্বচ্ছন্দ বোধ করি।
ছোটবেলায় দুধ থেকে বাচঁতে আমি কিছু অভিনব পন্থা অবলম্বন করতাম যেমন টয়লেটে ফ্লাশ করে দেওয়া , আমাদের সাথে যে চমৎকার মহিলাটি থাকতেন এবং আমাদের সব রকম কাজে সাহায্য করতেন তাঁকে দুধটি গেলানোর চেষ্টা করা, আমার ছোট ভাইকে নির্যাতন করা, জোর করে ওকে দিয়ে দুধটি গেলানোর চেষ্টা করানো, বারান্দা দিয়ে ফেলে দেওয়া যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রতিবেশীরা মা বাবার কাছে এই ব্যাপারে নালিশ করছে।
আমি প্লেটের খাবার নিয়ে খেলা করতাম। ঘন্টা ধরে খাবার মুখে নিয়ে বসে থাকতাম, চিবোতাম না, এক গাল থেকে অন্য গাল করতাম,শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতাম এই ভেবে যে হয়তো আমি খাবারটা শেষ না করেই টেবিল থেকে উঠে যেতে পারবো এবং কেউ আমাকে কিছু বলবে না।
সেই সময় মায়ের হতাশ গলা আমি প্রায়ই শুনতে পেতাম, “বেবি, খাবারটা গেল একটু”, এবং বাবার বজ্রধ্বনি, “ইথিওপিয়াতে অনেক লোক না খেয়ে মরে যাচ্ছে।”
শেষ না হওয়া খাবারটা মুখে রেখেই আমি অনিবার্য ভাবে বলতাম, “আমাদের বাড়ীর বাইরেই অনেক লোক খেতে পাচ্ছে না, খাবার গুলো তাদেরকে দাও।” মা বাবা আমাকে অনেক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন যারা আমাকে একগাঁদা প্রোটিন ড্রিঙ্কস খাওয়ানোর জন্য উপদেশ দিতেন। এগুলো খেতে ছিল জঘন্য, ‘Complan’ ছিল তাদের মধ্যে একটা।
মা লাঞ্চ টাইমে স্কুলে আসতেন আমাকে খাওয়ানোর জন্য। এটার জন্য তাঁকে স্পেশাল পারমিশন দাওয়া হয়েছিল। লাঞ্চের ছুটির সময়টা মা আর আমি একসাথে কাটাতাম। আমি চিবোতাম , গিলতাম না আর আমার বেচারী মা আমাকে অনুরোধ করতেন, মিষ্টি কথায় ভুলাতেন এবং মাঝে মাঝে লোভ দেখাতেন, “বেবি, মুখটা খোল, আর একটু খা প্লিজ।”
প্রত্যেক বছরই আমাদের একবার কলকাতা আসতে হতো। তখন আমার একদম ভালো লাগতোনা এখানে আসতে। আমার তখন মনে হতো এই শহরে আমাকে অনুপ্রাণিত করার মতো কিছু নেই। কলকাতাকে তখন অনেকটাই সংকীর্ণ এবং আঞ্চলিক মনে হতো। মনে হতো এখানে লোকেরা শুধু হাওয়া খায়, সব কিছুতেই একটা খুঁত ধরে, নিজেকে খুব বেশি করে জাহির করে, নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।
তাদেরকে আমার বাবার থেকে অনেকটা আলাদা মনে হতো। বাবা উনিশ বছর বয়সে তাঁর শহর ছাড়ে। বাবা অফিস থেকে এসে, স্নান সেরে, ধোয়া ইস্ত্রি করা সুতির পাঞ্জাবি পায়জামা পরতেন। তারপর বসতেন গল্প করতে আমার বড়ো মামীমার সাথে। আমার বড় মামিমা আসামের একজন চমৎকার মহিলা ছিলেন, সুন্দরী, ভদ্র – নম্র। কিন্তু তিনি মজা করতে খুব পছন্দ করতেন। তাঁর মজা যে কারুর শালীনতাকে আঘাত করতে পারতো । তার মজার মধ্যে বাৎকর্ম এবং খাবার প্রাধান্য পেত।
তাঁর অনেক অবিস্মরণীয় স্মৃতি এখনো আমার মনের মধ্যে গাঁথা আছে। তিনি খুব টিপ্ টপ থাকতেন, সাজগোজ করতে পছন্দ করতেন। আলিপুরে নিহারিকাতে সন্ধের ঠিক ৬ টার সময় তিনি তাঁর শয়ন কক্ষ থেকে বের হতেন, বন্ধুদের এবং আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। ওই সময়টাতে হুইস্কির গ্লাস এবং এপেটাইজারের প্লেট সব সময় তাঁর হাতে থাকতো।
খাদ্য এবং পানিও আমাদের নিত্যদিনকার জীবনের একটি অপরিহার্য এবং সর্বব্যাপী অংশ ছিল। একদিন আমি আমার ছোট মাসি এবং তার মেয়ে মুনিয়াদির সাথে আমি আমার সেজো মাসির বাড়িতে বেড়াতে যাই। আমার বয়স তখন ১২, সেজো মাসি তখন বেলেঘাটায় বিশাল বড়ো একটি বাড়িতে থাকতেন। বাড়িটির বারান্দা গুলো তাদের লাল মেঝের সাথে বাড়িটির দৈর্ঘ প্রস্থকে জড়িয়ে থাকতো।
খাবার পরিবেশন করা হলো। খুব বেশি পরিমাণে ভাত, ছোলার ডাল, বেগুন ভাজা, মাছ ভাজা, ঝিঙে পোস্ত, চিংড়ি মাছের বটি চর্চরি, ডিমের ডালনা এবং মাংস। যখন আমাদের খাবারের জন্য ডাকা হলো আমি এবং আমার ভাই বারান্দায় দিয়ে ছুটতে ছুটতে খাবারের ঘরে পৌঁছেছিলাম । আমরা বোম্বেতে একটি বড়ো ফ্ল্যাটেই থাকতাম তাও আমরা বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম ছুটাছুটির এতো স্বাধীনতা এবং এতো বড়ো একটি জায়গা পেয়ে।
আমার মনে আছে আমি খাবার টেবিলে অনিচ্ছাপূর্বক বসে ছিলাম। তৈরি হচ্ছিলাম আমার দিকে আসা অনিবার্য কিছু নির্দেশের জন্য – যা হোক কিছু একটা খেতে। সেজো মাসির বাড়ীতে এরকম ক্ষণস্থায়ী সময়ের জন্য আসা একটা রীতি এবং মা সবার সম্পূর্ণ মনোযোগ দাবি করলেন। তাঁর দাবিটা ন্যায্যও ছিল। নজনের মধ্যে সবার ছোট বোন হওয়ায় তিনি খুব আদরের ছিলেন। এতো হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে সবাই ছোট্ট শীর্ণ মেয়েটার কথা ভুলে গেলো যে স্বভাবত খেতে পছন্দ করে না। আধ ঘন্টা পর, কেউ একজন, হ্যাঁ, আমার ছোট মাসি আশ্চর্যান্বিত গলায় বললো, “দেখো, বেবি খাচ্ছে ?”
আমার নাম শুনে আমি উপরে তাকালাম এবং খেয়াল করলাম যে আমি খুব স্বাদের সাথে এক প্লেট ডাল, ঝিঙে পোস্ত এবং মাছ ভাজা গিলেছি এবং আমি আরো খাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছি । এটার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। প্রত্যেকবারের মতো সেই দুপুরে আমি খাবারের থেকে দূরে পালিয়ে যায়নি বরং কাছে এসেছি। সেই দুপুরেই একজন ভোজনরসিক জন্ম নেয়।
যদি খেতে পছন্দ না করা এক ধরনের সমস্যা হয় তাহলে, খেতে ভালোবাসা অন্য ধরনের সমস্যা। ছোটবেলা থেকেই আমি অরুচিকর খাবার খেতে পারি না। আমি কোনো কারণ দেখি না যে কেন কেউ একজন কোনো খাবার মুখে দিবে যেটা খেতে সুস্বাদু নয়।
রান্না আমার কাছে ধ্যানের মতো। রান্না আমার মনকে শান্ত করে, মনোনিবেশ করতে দেয় সেই খাবারটির প্রতি যেটি আমি বানিয়ে খেতে যাচ্ছি। ছোটবেলা থেকেই খাবার আমাকে ঘিরে ছিল তার সাথে ছিল বাবুর্চিরাও। বাবুর্চিদের ব্যাঙ্ক থেকে পাঠানো হয়েছিল, যেই ব্যাংকে আমার বাবা কাজ করতেন। তারা চমৎকার সব খাবার বানাতো, মা সেসব খাবারের তদারকি করতেন । মাও প্রতিদিন কোনো না কোনো একটা বিশেষ খাবার রান্না করতেন, যেটা তিনি জানতেন যে বাবা খুব আরাম করে খাবে।
আমি রান্না করা শিখি , কারন রান্না করা আমার জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পরে। আমার বাবা, যার ক্ষুধা ছিল কম কিন্তু যার খাবার সম্পর্কে কৌতূহল ছিল অনেক বেশি এবং কখনো কখনো দুঃসাহসিক, মাত্র সাত সেকেন্ডের মাথায় মরিশাসে আমরা তাকে হারিয়ে ফেলি একটা ফেটে যাওয়া অ্যানিউরিজমের ( aneurysm ) জন্য। বাবার বয়স তখন মাত্র ৪৮।
তারপর থেকে আমাদের জীবনের মোড় সম্পূর্ণ ঘুরে যায় কারণ ৪০ বছরের বিধবা হিসেবে মা সেই শহরটিতে ফিরে যাবার কথা চিন্তা করেন যেই শহরটি তিনি বিয়ের দিনই ছেড়ে দেন। এই শহরটিতেই তাঁর আত্মীয়স্বজন, বোনেরা , ভাইয়েরা, তাদের পরিবার, আর সবচেয়ে বড়ো কথা আমার বড়ো মামা, বড়ো মামিমা এবং মার বিধবা মা থাকতেন।
সুতরাং আমরা কলকাতাতেই ফিরে আসলাম। আমরা প্রচন্ড ভেঙে পড়েছিলাম এবং বুঝতে পারছিলাম না যে জীবন আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাবে। আমরা প্রথমে আমার এক মামার পরিবারের সাথে থাকা শুরু করলাম। তারপর আস্তে আস্তে যখন টাকা-পয়সা আসতে শুরু করলো তখন বুঝতে পারলাম একজন মানুষ তার ৪৮ বছরের জীবনে কতটুক টাকা – পয়সা তাঁর পরিবারের জন্য রেখে যেতে পারে।
যেই টাকা বাবা রেখে গিয়েছিলেন সেটা কম ছিল না। কিন্তু সেই টাকা আজীবন তিন জনের একটা পরিবারকে চালানোর মতো যথেষ্ট ছিল না। আমার বয়স তখন ১৭, আমার ভাইয়ের বয়স প্রায় ১৫ এবং আমার বিধবা মা যিনি কোনদিন কোনো অফিসে কাজ করেননি যদিও তিনি ইতিহাসে মাস্টার্স করেছিলেন।
রিসার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, যেখানে আমার বাবা কাজ করতেন, তাদের একটা নীতি ছিল যে চাকরিতে থাকা অবস্থায় কেউ মারা গেলে তাঁর পরবর্তী উপযোগ্য জ্ঞাতিকে একটি চাকরি প্রদান করা। আমার উপযুক্ত মা সেই চাকরিটি পায়।
যেই অফিসে আমার বাবা একসময় খুব খুব দাপটের সাথে কাজ করেছেন, সেই অফিসে আমার প্রচন্ড দৃঢ় এবং সক্ষম মা কাজ শুরু করেন একজন কয়েন সর্টার (sorter ) হিসেবে। মরিশাসে সরকারি ভাবে বন্দুকের গুলির আওয়াজের সাথে আমার বাবার অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আর আমরা এমন একটা শহরে চলে আসি যা কখনো আমাদের ঘর ছিল না। কিন্তু মরিশাস ছাড়ার আগে আমার বাবার এক বন্ধু আমাকে পোর্ট লুইসে একটি ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। কারন মৃত্যুর আগে বাবা তার বন্ধুকে বলেছিলেন যে তিনি খুব করে চান যাতে আমি এই রেস্টুরেন্টে এসে একবারটি খাই এবং এখানকার শেম্পয়নের গ্লাসে একবার চুমুক দেই।
পরিবারের কেউ একজন মারা গেলে শোকাগ্রস্ত পরিবারকে প্রথম ১৩ দিন অনেক কঠিন নিয়ম মেনে চলতে হয়। তার মাঝখানেও আমি ড. লালের সাথে ড্রাইভ করে সেই রেস্টুরেন্টিতে যাই। বাবার ইচ্ছেমতো আমি সেখানে খাই, কান্নায় ভেঙে পড়ি এবং আমার প্রথম শেম্পয়নের গ্লাসটা আমি আমার এতো কম বয়সে চলে যাওয়া বাবাকে উৎসর্গ করি।
কলকাতায় আসার পর আমার মাকে তাঁর ভাই-বোনেরা অনেকটাই দেখে শুনে রাখে এবং তাँরা একা একা দুঃখ করতে দেয় না। তাँরা সবাই মাকে বাবার গল্প বলে , মাকে সেসব খাবার বানাতে বলে যেগুলো বাবা খেতে ভালোবাসতো এবং তাঁরা মাকে সেসব কাপড় পড়তে বাধ্য করতো যেগুলোতে মাকে দেখতে বাবা খুব পছন্দ করতো। এভাবেই আমাদের স্মৃতিতে বাবাকে তাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছিলো।
আমিও মায়ের সাথে রান্না করতাম। আমাদের তখন একজন ঠিকা ঝি ছিল, যে কাটাকুটি করে দিতো, শীল নোড়ায় বাটনা বেটে দিতো। আমি খুব শীঘ্রই রান্না করাটা আয়ত্ত করে ফেলি এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমি হাক্কা চাও এবং চিলি পর্ক বানানো শুরু করি। যখন সিলিন্ডারে গ্যাস শেষ হয়ে যেত তখন আমি কেরোসিন স্টোভে রান্না করতে পিছপা হতাম না।
বাঙালি পুরুষরা আমার বন্ধু হওয়া শুরু করে এবং তাদের সম্পর্কে আমার যা ভ্রান্ত ধারণা ছিল সেটা বদলে যায়। কলকাতাতে আমি অসাধারণ সব খাবার খাই , এসব খাবার যা শুধু কলকাতাতেই পাওয়া যায়, কাঠি রোল থেকে ফুচকা; মোকামবোর সিজলার থেকে বারবিকিউর ফ্রাইড রাইস; জিমির কিচেন চিমনি সুপ থেকে এলগিন রোডের থুপকা; নিজামের বিরিয়ানি থেকে সকালবেলার চাইনিস ডাম্পলিংস এবং পাও বানস। সকাল সকাল এগুলো কিনতে পাওয়া যেত যখন অন্যরা দাঁত মেজে মাত্র দিন শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও কলকাতা আমার কাছে একজন দূরের আত্মীয়র মতো মনে হতো, যার সাথে হয়তো সম্পর্ক আছে কিন্তু ঘনিষ্ঠতা নেই।
আমি ছ’বছর পর কলকাতা ছেড়ে আমেরিকার মিডওয়েস্টের ছোট একটি শহরে চলে আসি। প্রথমে মাস্টার্স, তারপরে কম্পারেটিভ লিটারেচারে পিএইচডি করি। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি মানসিক ভাবে একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম, আমেরিকায় আসার পর অন্যরকম একটা ধাক্কা খাই।
ক্রোগের বলে সেখানে একটা রিটেইল স্টোর আছে, সেখান থেকে আমি একটা বরফে ঢাকা মুরগি উঠাই। এই রিটেইল স্টোরে হাজার হাজার জিনিস পাওয়া যায়। আমি ভাবি অবসর সময়ে এসে একদিন সব খুঁটিয়ে দেখবো। এই স্বাধীন দেশে আমার নিজেকে স্থানচ্যুত মনে হচ্ছিলো এবং এখানে এসে প্রথম দিকে মারাত্মক হতাশাও কাজ করছিলো। আমি আস্তে আস্তে এই রিটেইল স্টোরের হাজার হাজার জিনিসগুলো খুঁটিয়ে দেখা শুরু করি, কিন্তু প্রথম সপ্তাহে আমি খাবার জন্য কিছু একটা খুজছিলাম। আমি ভেবেছিলাম যে মুরগির একটি সিম্পল ঝোল বানাবো।
মুরগির সাথে আমি কিছু পেঁয়াজ, গাজর, মটরশুঁটি এবং আলু কিনি। বাড়িতে নুন, গোলমরিচ, ওরচেস্টারশায়ার সস, অল্প মাখন এবং কিছুটা ময়দা ছিল। যে আমাকে রিটেল স্টোরে সঙ্গে দিচ্ছিলো সে আমাকে পরামর্শ দিলো যাতে আমি এক বোতল মিক্সড হার্বসও কিনি।
আমি খুব যত্নের সাথে মুরগির ঝোলটি বানাই। খুব সুন্দর ঘ্রান বের হয়, ঝোলের গন্ধে আমার গ্রাউন্ড ফ্লোর ম ম করে। মুরগির ঝোলের সাথে আমি কিছুটা ভাতও বানাই, তারপর খেতে বসি। মুরগিতে একটি কামড় বসাই এবং আমার বমি চলে আসে। আমি থু করে মুরগির টুকরাটা মুখ থেকে ফেলে দেই। এটা কি হলো ? আমি বুঝতে পারিনি । আমি তো সবকিছু ঠিকই করেছিলাম। ঝোলটি খেতে খুব সুস্বাদু হয়েছিল কিন্তু মাংসটি একেবারে বিস্বাদ। সেদিন আমি বুঝলাম মুরগির ক্ষেত্রে হয়তো সাইজটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং উল্টো। যত বড়ো মুরগি ততোটাই খারাপ খেতে।
কিন্তু জিততে আমাকে হতোই। গ্রামাটোলজি এবং এক্রিটস নিয়ে পড়াশুনো করতে করতে আমি মুরগি নিয়েও নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতাম। প্রথমে মুরগির পাখা আর রান নিয়ে কাজ শুরু করি কারন এগুলো তুলনামূলক ভাবে সস্তা ছিল এবং এগুলোতে হাড্ডি ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি বুঝতে পারি যে এই পাখিগুলো কে সুস্বাদু করার একটি উপায় হচ্ছে রান্নার কিছুক্ষন আগে কাটা মুরগির পিসগুলোকে লেবু এবং নুন দিয়ে ম্যারিনেট করে রাখা। তারপর ধুয়ে কাটা পিস গুলোকে শুকানো। তারপর আবার রসুন, আদা, এবং আরো কিছু সুগন্ধি মসলা দিয়ে আরো কিছুক্ষন ম্যারিনেট করা এবং তারপর কমপক্ষে ১৫ মিনিট বেক করা। চুলোতে কিছু বানানোর চেষ্টা করার আগে আমি এভাবেই বাড়িতে মুরগি রান্না করতাম।
আমি বলবোনা আমার রান্না খুবই চমৎকার হতো কিন্তু আমি এটা জানতাম যে ওই ছোট শহরে আমার রান্না করা মুরগি থেকে ভালো মুরগি সেখানে কেউ খায়নি। আমি মুরগির অনেক কিছু বানাতাম, যেমন মুরগির ঝোল, টেরিয়াকি, ছোট ছোট বলের মতো মিটবল এবং মুরগির রোস্ট। আমি খুব কম উপকরণ দিয়ে রান্না করা আয়ত্ত করেছিলাম এবং আমি প্রায়ই নতুন নতুন খাদ্য উদ্ভাবন করতাম নতুন মশলা এবং হার্বস এর সাহায্যে।
আমি খুব খুশি হলাম যখন আমি একটা সুযোগ পেলাম মিডওয়েস্ট ছেড়ে সিয়াটেলে স্থানান্তর করার জন্য। আমি জানতাম সিয়াটেলে আরো অনেক সুস্বাদু আনন্দ আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে । সিয়াটেল সমুদ্র এবং পাহাড়ের মাঝখানে খুব সুন্দর একটি শহর। আমার মনে হয় সিয়াটেলকে বানানোই হয়েছিল বেশ বেশি আহার করার জন্য।
সিয়াটেলেই আমি প্রথম সুস্বাদু সুশি এবং ভিয়েতনামিজ রাইস রোল সম্পর্কে জানতে পারি। আরো জানতে পারি ফোঁ এবং মসলাদার সিচুয়ান রন্ধনপ্রণালী সম্পর্কে, জানতে পারি ইথিওপিয়ান ইনজেরা এবং থাই কারী সম্পর্কে। চিনতে শিখি কিং স্যামন এবং বিগ প্ৰৌনকে, কলকাতায় যেটাকে আমরা গলদা চিংড়ি বলি এবং পল্লবিত হার্বস এবং প্রচুর সবুজ শাকসবজির সন্ধান পাই যেগুলোর সাক্ষাৎ আমি আগে পাইনি।
কখনো কখনো আমি বাসে চড়ে পাইক প্লেসে যেতাম মাছ ব্যবসায়ীদের কেনা বেচা দেখতে। এই জায়গায় কোনো একটা ব্যাপারতো ছিল যা আমাকে কলকাতার মাছ বাজারের কথা মনে করিয়ে দিতো যা আরো একটু পরিষ্কার – পরিচ্ছন্ন ছিল। আমি টাকা বাঁচাতাম একটা ভালো লাঞ্চ বা ডিনার উপভোগ করার জন্য। আমি খুব বেশি দামি রেস্তুরাঁতে যেতাম না, যেখানে যেতাম সেসব জায়গা সিয়াটলের প্রত্যেকটি গলিতে খুঁজে পাওয়া যায়। শুধু মাত্র এই সময়টিতেই আমি মিতব্যয়ী হতাম না।
কিন্তু যখন মা আমার কাছে ঘুরতে আসলো, আমরা একটু দামি রেস্টুরেন্টে যাওয়া শুরু করলাম। আমি যখন সেমিনার এটেন্ড করতাম মা তখন এসব রেস্টুরেন্ট গুলো খুঁজে বের করতেন । একটা সময় কফি আবেগে রূপান্তরিত হলো এবং অবশেষে আমি ওয়াইনের আসল আনন্দটা খুঁজে পাই। আমি আমার ভ্রমণগুলো রেস্টুরেন্টের উপস্থিতি অনুযায়ী পরিকল্পনা করা শুরু করি। কিভাবে ফ্রেঞ্চরা জোরাজুরি করে আমাদের তাদের রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবে যেখানে অন্যদের যাওয়া মুশকিল সেই কলাটাও আমি শিখে ফেলি।
তারপর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ড ভ্যান আমার মাকে ধাক্কা মারে। সেটা একটা ভয়ানক মৃত্য ছিল। আমি এখনো এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে পারি না। আমার টেনিউর সেলেব্রেশনের মাত্র দু দিন পরেই মা মারা যান। মার মৃত্যু আমার উপর একটা গভীর প্রভাব ফেলে। এখনো এই যন্ত্রনা থেকে আমি মুক্তি পাইনি। হঠাৎ হঠাৎ যখনি মার কথা মনে হয়, আমি যাই কিছু করতে থাকিনা কেন তখন আমার একটা বিরতি নিতে হয়, তারপর শুধুই একটি বিষাদভরা দীর্ঘশ্বাস।
আমরা একসাথে এতদিন যেই রান্নাগুলো করেছি সেই রান্নাগুলোই এখন আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, চিকেন কাটলেট, আস্ত চিংড়ির ফ্রাই, আলু এবং বিটের সালাদ পৃথিবীর সেরা ঘরে তৈরী মেয়ো দিয়ে, এংলো ইন্ডিয়ান চিকেন রোস্ট, ঠাকুরবাড়ির আদা মাছ এবং নিরামিষ পাঠার মাংস।
ওভেনের প্রতি মার ভালোবাসা আবিষ্কার হয় যখন তিনি প্রথম আমার কাছে আসেন। তখন তিনি অনেক কেক বানাতেন। একদিন তিনি বললেন যে, “ওভেন মানবসভ্যতার একটি প্রতীক।”
মার ভীল অস্সোবুকো (veal ossobuco) টা আমি এখনো ঠিক করে বানাতে পারি না যেমন আমি বানাতে পারি না স্যামনের কৌলিবিয়াক (coulibiac) যেমনটা মা সে পানিসের (chez panisse) মেনু কুকবুক থেকে বানাতেন।
তারপর আমি আরো একটি ধাক্কা খাই, এবারের ধাক্কাটি ছিল শারীরিক। এতো কষ্ট যা কল্পনার অতীত। আমার শরীরে ভেতর কিছু অঙ্গের সংযুক্তি হয়, যা হওয়া উচিত ছিল না। আমার শরীরে নিচের দিকের কোলনের সাথে সুষুম্না মিলিত হয়ে মৃত্যুর এক তান্ডব নিত্য শুরু করে। এটার কারণে শরীরের বর্জ্যগুলো আমার মস্তিকে চলে যেত এবং আমি প্রচন্ড মাথা ব্যাথায় ভুগতাম।
আমি যখন ইমার্জেন্সি রুমে যাই, আমাকে তাড়াতাড়ি হপ্কিন্সে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আমি জানতে পারি সেখানে তারা আমার মেরুদণ্ডের উপর একটা অস্ত্রোপচার করে শরীরের দুটি জোড়া লেগে যাওয়া অংশকে আলাদা করে এবং কলোসটমি করে। পুরো অস্ত্রোপচারটা করতে তাদের ১০ ঘন্টার মতো সময় লাগে এবং তারা আমাকে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
চিন্তা করো প্রচন্ড শারীরিক যন্ত্রনা নিয়ে সজাগ হওয়া আর উঠে দেখা যে আমি একটা বরফের চাদরে শুয়ে আছি যাতে আমার শরীরের তাপমাত্রা নিচে নামে। আমার শরীরের চারিদিকে নল লাগানো, নার্স আমাকে পাঁচ মিনিট পর পর জিজ্ঞেস করছে বছর, তারিখ, মাস, বর্তমান প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে। দেখছে আমি কিছু ভুলে গেছি কিনা। আর দেখছে আমার পাকস্থলীর পাশের একটা ছিদ্র , কোলনের একটি অংশ, যেটি দিয়ে শরীরের বর্জ্য বের করা হবে আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
প্রচন্ড যন্ত্রনায় আমি তখন হ্যালুসিনেট করা শুরু করি। চিন্তা করতে থাকি বেকেটের ব্যাপারে। আমার মনে হয় আমি সে যাত্রায় বেঁচে যাই কারণ আমার চিন্তায় আমি বেকেটের নাটকে অভিনয় করছিলাম। আড়াই মাস পর অনেক জটিলতার সম্মুখীন হয়ে অবশেষে আমি বাড়ি ফিরি, নতুন করে শিখি কিভাবে হাঁটতে আর খেতে হয়। কলোসটমি একটি জঘন্য জিনিস। তাদেরকে ভালো মতো ঢেকে রাখতে হয়, যথাথ ভাবে সীল করে এবং সঠিক সাইজের ব্যাগ দিয়ে যাতে কিছু লিক না করে। এটা শুনতে যতটা সোজা, বাস্তবিক জীবনে ততটাই কঠিন। আমি প্রায়ই ব্যর্থ হতাম এতে। কিন্তু যেভাবে আমি অবশেষে সিয়াটেলে সঠিক ভাবে মুরগির স্বাদটা বের করে আনি ঠিক সেভাবেই আমি কলোসটমি এবং কলোসটমি ব্যাগের বিভিন্ন কলাকৌশল আয়ত্ত করি এবং সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে সার্থক হই।
যেসব খাবার খেতে আমি পছন্দ করি সেসব খাবার ছেড়ে দাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সারাদিন ঘরে বসে থাকবো, বের হবো না, সেটাও সম্ভব না। নিজের শরীরকে ভালোবাসো, আলিঙ্গন করো, আমি নিজেকে বলি। নিজের শরীরের সাথে লড়াই করো না, কিন্তু তোমার জীবন কিভাবে চলবে সেটার নির্ধারণ শরীরকে করতে দিয়ো না।
নভেম্বরে বাড়িতে ফিরে আসার পর আমি প্যারিস যাই এবং আনন্দের সাথে খাই। আমি শিখি কিভাবে ছোট থেকে ছোট বাথরুমে ব্যাগ চেঞ্জ করতে হয়, আমি জানতাম যে কোনো সময় ব্যাগ লিক করতে পারে বা এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে তাই আমি সবসময় আমার সাথে প্রয়োজনের বেশি ব্যাগ রাখতাম, তাছাড়া আন্ডারওয়্যার, সাবান, মুছার জন্য টিস্যু এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক সেট নতুন কাপড়। আমি খাই, পান করি, ভ্রমণ করি এবং নতুন করে বাঁচতে শিখি।
দু- বছর পর, ডাক্তার আমাকে বললেন যে আমি কলোসটমিটা সরাতে পারবো। আরেকটা কঠিন অস্ত্রোপচার যার আরো অনেক জটিলতা আছে। আমি খুশি হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এখন সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার শরীর বললো, একটু সবুর করো, এতো খুশি হয়ো না। অস্ত্রোপচারের দু মাস পরে আমি খেয়ে কিছু হজম করতে পারতাম না। বর্জ্য ত্যাগ করার সময় প্রচুর রক্ত বের হতো যদিও ডাক্তার বলেছিলেন যে এখন কোলন আস্তে আস্তে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে।
অবশেষে, তিন মাস না খেতে পারার পর আর অনেক ওজন ঝরে যাওয়ার পর ( প্রায় ১২ কিলো) এবং বেশ কিছু কোলনোস্কোপি করানোর পর আমাকে ডাক্তার বললেন যে আমার আলসারেটিভ কোলাইটিস ধরা পড়েছে। তারা তখন আমাকে এবং আমার পার্টনারকে ছবিটি দেখালেন। আমার পার্টনার তখন আমার সদ্য হওয়া একজন বয়ফ্রেন্ড যার সাথে আমার অস্ত্রোপচারের দু মাস আগে পরিচয় হয়। তার আগেই আমার ২১ বছরের বিবাহিত জীবনের এক বেদনাদায়ক পরিসমাপ্তি ঘটে। ছবিতে আমরা দেখলাম যে আমার কোলন একটি উত্তপ্ত অস্ত্রের মতো, মনে হচ্ছিলো এর লাল এবং সাদা অংশ একটি আইসক্রিমের চামচ দিয়ে টেনে বের করা হচ্ছে । মনে হচ্ছিলো এটি প্রচন্ড ক্রোধিত, এবং আমাকে বার বার জানান দিচ্ছিলো যে, এটিকে মুক্ত করে পুনরায় অস্ত্রোপচার করে সংযুক্ত করাটা আমার উচিত হয় নি। আমি জানতাম আমাকে মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকতে হলে এটির সাথে মানিয়ে চলতে হবে।
যখন আমার প্রথমদিকের ভয় একটু কমলো, আমি ভাবলাম একজন ভোজনরসিকের জন্য কি বাজে একটা রোগ এটা। আমাদের কল্পিত গ্যাস্ট্রিকের থেকেও খারাপ।
এখন প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে যে আমি এই রোগটি নিচে বেঁচে আছি। কিছু ওষুধ আমাকে সাহায্য করছে এই ওষুধটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। তারা যেমন সাহায্য করছে সাথে সাথে কিছু ক্ষতিও করছে। এই ওষুধগুলো যেমন হামিরা এবং মারসেপ্টপিউরিন এবং আরেকটি ওষুধ যেটার নাম মেসালামীমশরীরের আমার শরীরের অটোইমিউন নষ্ট করে দিচ্ছে।
আমার মনে আছে বাস স্টপের কিছু এড : মহিলাদের পা মাটিতে আঘাত করছে আর তারা একটি অদৃশ্য টয়লেটে বসা। আমি তাদের সাথে অনেক মিল খুজে পেতাম। আমি তাদের একজন হতে চেতাম। কলোসটমি নিয়ে বেঁচে থাকা একধরণের সমস্যা কিন্তু আলসারেটিভ কোলাইটিস নিয়ে বাঁচা অন্যধরনের একটি সমস্যা। গুণগত মান দিয়ে জীবন একটু সোজা হয়ে যায়, লুকোনোর প্রয়োজন কম পরে এবং অবশ্যই আমি যদি আমি না হতাম তাহলে হয়তো জিনিসগুলো আরেকটু সোজা হতো।
আমি বিচক্ষণতার সাথে কম খেতে পারতাম, মদ্য পান কম করতে পারতাম যাতে আমার কোলন উত্তক্ত না হয়। কিন্তু সারাদিন শুধু সেদ্ধ করা মিষ্টি আলু এবং জল খেয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারতাম না।
আমার গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট, যে আমার মতোই একজন ভোজনরসিক আমাকে বলেছিলেন, হয় তুমি এই রোগটিকে নির্ণয় করতে দাও তুমি কি খেতে পারো আর পারো না আর অথবা তুমি তোমার শরীরকে অনুশীলন করাও যাতে তুমি যা খাও তোমার শরীর তা গ্রহন করতে শিখে। তুমি খাবার খেতে ভয় পেতে পারো অথবা … আমি তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দেই। আমি, খাবার খেতে ভয় পাবো ?
হামিরার প্রথম ডোজ নাওয়ার পর আমি খুব ভালো করে রাতের খাবারটি খাই, তার মধ্যে সুইটব্রেডও ছিল কিন্তু এর একটা প্রভাব আমার শরীরের মধ্যে পরে। আমার বয়ফ্রেন্ড অনেক চেষ্টা করে কিছু না বলার জন্য। সেদিন রাতে আমি একটু ভুগি কিন্তু আমার এক ফোটাও অনুশোচনা হয়না। তাছাড়া বাথরুমগুলো বানানো হয় কি জন্য ?
আমার বয়ফ্রেন্ড আমার অসুস্থতার সময় আমার খুব কাছের একজন সঙ্গী। আমি আমার ব্যবহারে কিছুটা পরিবর্তন আনি। যেখানে ঘুরতে যাই সেখানে বাথরুম কোথায় সেটি জানা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। খাবার গ্রহন করার সময় মাঝেই মাঝেই বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পরে। যখন আমি পড়াই তখন আমি আমার সময়সূচী হিসেবে খাই। তখন কখনো কখনো আমার ৭-৯ ঘন্টা খাওয়া হয় না। তখন আমাকে উজ্জীবিত করে রাখে সেই সন্ধ্যায় আমি কি রান্না করবো, এবং রান্না করার সময় আমি কোন ওয়াইনটি পান করবো তার চিন্তা অথবা আমার প্রিয় থাই রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার অর্ডার দেওয়ার চিন্তা যারা পাঁচটা লঙ্কা ব্যবহার করে ঝালের মাত্রা বোঝানোর জন্য।
আমি উশুইয়া, প্যাটাগোনিয়াতে খুব দামি রেস্টুরেন্টে খেয়েছি এবং অজান্তা , ইলোরা যাওয়ার সময় রাস্তার মাঝখানে স্থানীয় রেস্টুরেন্টেও খেয়েছি। আমি অবশ্যই খাবার খাওয়ার আগে আমার প্লেট এবং চামচ , ভারতে থাকলে পেঁয়াজ, শশা এবং টমেটোর সালাদ খাবার জল দিয়ে ধুয়ে নেই। আমি এখনো ভারতে রাস্তার খাবার খেতে ভয় পাই কিন্তু একদিন সাহস জুগিয়ে অবশ্যই খাবো।
সময়ের সাথে আমার শরীরের সাথে আমার এক কাছের সম্পর্ক তৈরি হয়। আমি তাকে বোঝার চেষ্টা করি, শোনার চেষ্টা করি। কিন্তু কখনো কখনো আমি তাকে বলি তোমার যা ইচ্ছে করো, আমি আজকে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ‘ব্রেন ফ্রাই’ খাবো এবং তখন সে আমাকে কোনো কষ্ট দেয় না। কিন্তু মাত্র দু দিন পর যখন আমি একটা সেদ্ধ মুরগি খাই তখন আমার শরীর উত্তপ্ত হয়ে যায় এবং অনেক কষ্টে আমার তার রাগ ভাঙাতে হয়। আমাদের এক সাথে থাকতে হয়, আমার শরীর এবং আমি, অবিচ্ছেদ্য, কখনো কখনো অসমঞ্জস্যপূর্ণ, যে কোনো একটা সম্পর্কের মতো।
আমরা জানি লেগুম খেতে অনেক শক্ত। ডাল, যা বাঙালিদের খাবারে অপিরিহার্য, তা আমি শুধু সপ্তাহে একদিন খেতে পারি। কাঁচা সবজি এবং সালাদ আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আমি এতটা পাত্তা দেই না কারণ আমি খরগোশ না। কিন্তু আমি অন্য সবকিছুই খাই। ঘরের মধ্যে আমি লাল মাংস একটু কম খাই, মুরগি এবং মাছ এখন বেশি প্রাধান্য পায়। আমি এখনো রেস্টুরেন্টের উপস্থিতির কথা চিন্তা করে আমার ভ্রমণের পরিকল্পনা বানাই এবং যখনি সময় পাই আমি ঘরের মধ্যে সুস্বাদু খাবার রান্না করি।
আমি ঘরের মধ্যে ডিনারের আয়োজন করতে বেশ ভালোবাসি এবং নতুন নতুন রান্না করতে পছন্দ করি। আমি একজন খুব ভালো রাধুনী (কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই বলছি) এবং আমি এমন একটি পরিবার থেকে আসি যেখানে আমার থেকে আরো ভালো মহিলা রাঁধুনি আছে আমার পরিবার তাদের মহিলাদের নিয়ে খুব গর্ব বোধ করে।
আমি খাবার নিয়ে এতো সহজে হাল ছেড়ে দিচ্ছি না। আমি বাঙালি এবং আমার মা বাবার সন্তান। আমি রান্না করে তাদেরকে স্মরণ করার জন্য বেঁচে থাকি, আমার মা – বাবাকে, যাদেরকে আমাদের থেকে খুব কম বয়সে নিয়ে নাওয়া হয়েছে।
আমার একটি কঠিন রোগ আছে এবং এটি গ্যাস্ট্রিক নয়। কিন্তু আমি জানি আমি বেঁচে থাকবো। এখন, আমার খুব করে ঝাল করে বানানো একটি ওমলেট খেতে ইচ্ছে করছে।
অবশিষ্ট: গত দশ বছরে আমি আগের থেকে বেশি কলকাতা ভ্রমণ করেছি এবং আস্তে আস্তে আমি শহরটিকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। এর ঔপনিবেশিক পরিকাঠামো; দা বেঙ্গল ক্লাব যেখানে কলকাতার শ্রেষ্ঠ চিলি চিকেন পাওয়া যায় ; অতিবসুন্দর মানুষজন যারা আপনাকে তাদের ছাদে নিমন্ত্রণ করবে বেশ ভালো ডিনার এবং বাক্যালাপের জন্য; কলকাতার সহজ এবং শান্তি প্রিয় জীবন ( দিল্লির এবং মুম্বাইয়ের হৈচৈ থেকে একদম আলাদা ) এবং সব থেকে বেশি একটি পারস্পরিক আস্থা এবং শুভেচ্ছার অনুভূতি যেটা এখন অনেক বেশি স্বাগত মনে হয় আমার কাছে।
যদিও কোভিডের জন্য আমার ভ্রমণ করা অনেকটা বাধাগ্রস্থ তাও আমি আশা করি যে খুব শীঘ্রই আমি আবার ভ্রমণ করা শুরু করবো। আমি একটি খাবারের লিস্ট বানিয়েছি, কলকাতায় পৌঁছানোর প্রথম দিনই আমি এগুলো খাবো : ভেটকী ফ্রাই, ডাল, চর্চরি এবং পাবদা মাছের ঝোল।
Wow! Great. It remains family lunch during durga pooja.